১৯৪৮ সালের ১৯শে মার্চ পাকিস্তানের জাতির জনক কায়েদে আজম মহম্মদ আলি জিন্না ঢাকায় এলেন। ২৪শে মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তন উৎসবে ভাষণ দিতে এসে বললেন, “প্রিয় ছাত্রগণ আমি তোমাদের জানাতে চায় যে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা একমাত্র উর্দুই হবে। এ ভাষার মারফত ইসলামের সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য যেমন প্রকাশ পেয়েছে অন্য কোনো ভাষায় তা হয়নি”। সে সময় আকস্মিক কয়েকজন ছাত্র একযোগে প্রতিবাদ করে উঠলেন – না -না – না। এদের মধ্যে একজন ছিলেন বরিশালের সর্দার ফজলুল করিম।
১৯৪৮ সালের ২৮শে মার্চ কায়েদে আজম ঢাকা ত্যাগ করলেন। কিন্তু তিনি দুটি কথা স্পষ্ট উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন। প্রথমতঃ পূর্ব-পাকিস্তানের বাঙালিরা আর পশ্চিমের আজ্ঞাবহ হয়ে থাকতে রাজি নন এবং দ্বিতীয়তঃ তাঁরা যেকোনো মূল্য দিয়ে তাঁদের মাতৃভাষার মর্যাদা রক্ষা করবেন।
কিন্তু করাচির অবাঙালি আমলাতন্ত্র পূর্ব-বঙ্গে উর্দু প্রচার অভিযান চালিয়ে পূর্ব-বাংলার ধর্মপ্রাণ সরল মুসলিম জনতার কাছে উর্দুভাষাকে কোরআনের ভাষা বা “লিসানুল কোরআন” বলে তুলে ধরল। দেশের মধ্যে যারা শরীফ বলে নিজেদের মনে করত, তারা খুশিতে আত্নহারা হয়ে বললেন, “বাংলা ইতরজনের ভাষা , উর্দু শরাফতির ভাষা ।”
আতাউর রহমান খান তাঁর গ্রন্থ “ওজারতির দুই বছর”-এ বলেছেন, পূর্ব পাকিস্তানে লোকে যাতে করে রাতারাতি উর্দু শিখতে পারে তার মহড়া চলতে লাগল পুরাদস্তুর। রেডিও পাকিস্তান হররোজ ৫মিনিট উর্দু সবক দিতে লাগল। পূর্ব বাংলার মানুষকে উর্দু হজম না করায়ে ছাড়বে না। স্কুল পাঠ্য বই নতুন করে লেখা হতে লাগল উর্দু ‘লবজের’ গাঁথুনি দিয়ে – সৃষ্টি হল এক বিচিত্র বাংলা ভাষার। অনেক অতি উৎসুক ব্যক্তিরা কসরৎ চালাতে শুরু করল। যদি নেহাত বাংলা নাই ছাড়তে পার – তবে একটু ইসলামী লেবাস পর্যায়ে দাও। হিন্দুয়ানির বুদ্-বু (গন্ধ) কেটে যাবে। কয়েকজন পন্ডিতের মাথা খুলে গেল, আদাপানি খেয়ে নামল কসরৎ করতে। গবেষণাও চলল জোর। নতুন আবিষ্কার জগৎকে স্তম্ভিত করে দেবে।
লিয়াকত আলী খানের সঙ্গে আওয়ামী লীগের নেতা আতাউর রহমান খান সাহেবের এক সাক্ষাৎকার থেকে জানা যায়- “উর্দু পাগল লিয়াকত জনাব আতাউরকে বললেন, কি চেঁচামেচিই না করছেন এই ভাষা নিয়ে। এতে আপনাদের গৌরবের কি আছে? বাংলা ভাষা হিন্দু সংস্কৃতির ধারক ও বাহক, অথচ এই ভাষা নিয়ে মারামারি করে আপনারা পাকিস্তানের মূল আদর্শটাই ধ্বংস করে দিচ্ছেন।”
[তথ্য সূত্র: পূর্ব বাংলা – অমিতাভ গুপ্ত ]