সরাইলে আমরা প্রতিরক্ষা বুহ্য গড়ে তুললাম। আমরা সবাই ক্লান্ত। অনাহারের চতুর্থ দিন অতিবাহিত হতে চলেছে। এই চার দিনে পানি ছাড়া পেটে একটি দানাও পড়েনি কারো। দীর্ঘ হাঁটার ফলে সবারই পা ফুলে উঠেছে। শীতের বিকেল। সূর্য অনেকটা পশ্চিমে সরে গেছে।
হঠাৎ লক্ষ্য করলাম ১৫ কি ১৬ বছরের একটি ছেলে আমার দিকে এগিয়ে আসছে। পরনে হাফ প্যান্ট হাফ শার্ট। কাঁধে ঝোলানো একটি ৩০৩ রাইফেল। রাইফেলটি তার থেকে লম্বায় কিছুটা বড়োই হবে। বেসামরিক মুক্তিযোদ্ধা সে । খুব বিনয়ের সাথে মুক্তি বাহিনীর কমান্ডারের সাথে দেখা করতে চাইল সে। তাকে কিছুটা উদ্বিগ্ন মনে হলো। সে জানাল তার এক সহযোদ্ধা মারাত্নক আহত হয়ে মহাসড়কের পাশে পড়ে আছে। অবিলম্বে তার চিকিৎসা প্রয়োজন। সে খুব অনুনয় করে আমাদের ডাক্তারের সাহায্য চাইল।
আমাদের ডাক্তার আলী আহমদ সে সময় বেশ পেছনে অবস্থান করছে। ছেলেটি ঠাঁয় দাঁড়িয়ে রইল। মুখে তার স্পষ্ট অস্থিরতার ছাপ। লক্ষ্য করলাম তার চোখ অশ্রুসজল হয়ে উঠেছে। হাতজোড় করে সে বলল, স্যার, একটু সাহায্য করুন। দেরি করলে ও হয়ত বাঁচবে না। একজন ডাক্তার আমার সাথে দিন।
আমি বললাম, আমাদের ডাক্তার এখন থেকে অন্ততঃ মাইল খানেক পেছনে আছে। দায়িত্ববোধ আর মানবিকতার আহবান – এই দুয়ের দ্বন্দ্বে অবশেষে উঠে দাঁড়ালাম। বললাম, চলো। সরাইলের ত্রিমোহনী সংলগ্ন সিলেট-ব্রাহ্মণনবাড়িয়া সড়কের এক পাশে একটি কৃষ্ণচূড়া গাছের নিচে আহত মুক্তিযোদ্ধার রক্তাপ্লুত দেহটি মাটিতে পড়েছিল। তার পাশে বসে আছে আরও দুজন তরুণ মুক্তিযোদ্ধা। আমি আহত মুক্তিযোদ্ধা ছেলেটির কাছে গিয়ে বসলাম।
তার শরীরে পাশাপাশি দুটো গুলি প্রবেশ করেছে। একটি ডান দিকের ফুসফুস ভেদ করেছে এবং অপরটি তারই প্রায় এক ইঞ্চি নিচে। চোখদুটি হলুদ হয়ে এসেছে। চোখের পাতা বুজে আসছিল বারবার। জোড় করেই চোখ খুলতে চেষ্টা করছে সে। চোখের দৃষ্টিও লক্ষ্যহীন। আহত এই মুক্তিযোদ্ধা ছেলেটিও বয়সে তরুণ। অবয়বে কৈশোরের ছাপ এখনও স্পষ্ট। পরনে হালকা সবুজ রংয়ের প্যান্ট এবং গায়ে হাফ হাতার শার্ট। শার্টের রং বোঝার উপায় ছিল না। রক্তে ভিজে লাল হয়ে গেছে।
সে তার বাঁ হাতটি আলতোভাবে উঠানোর চেষ্টা করছিল। তার হাতে হাত রাখতেই আমার হাত চেপে ধরল। ফিসফিস করে কি যেন বলার চেষ্টা করল বারবার। নাক মুখ দিয়ে ফোঁটা ফোঁটা রক্ত গড়িয়ে পড়ছে অনবরত। খুব অস্পষ্টভাবে জানতে চাইল, সে কোথায় আছে। আমি বললাম, বাংলাদেশের ভেতরে সরাইলে আছে সে। তারপর কিছুক্ষন লক্ষ্যহীনভাবে তাকিয়ে থাকল। খুবই অস্পষ্টভাবে আবার বলল, আমি বাঁচবো তো? একথা শোনার পর তার সাথে সহযোদ্ধা বন্ধুরা ডুকরে কেঁদে উঠল। মুখে কষ্টের রেখা ফুটে উঠেছে তার। ক্ষীণকণ্ঠে বলল, আমার খারাপ লাগছে।
এটাই ছিল তার শেষ কথা। তারপর অস্থিরতার মাত্রা বেড়ে উঠল এবং একটু বাঁকা হয়ে দুহাত দিয়ে সে আমার কোমর জড়িয়ে ধরল। এই বাঁধন ক্রমে শিথিল হয়ে আসতে লাগল এবং কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই তার রক্তাক্ত দেহটি আমার কোলে নিথর হয়ে পড়ল।
[ তথ্য সূত্র: যুদ্ধে যুদ্ধে স্বাধীনতা – মেজর নারী উদ্দিন ]